বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:২১ অপরাহ্ন

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় চরম সংকট

হুমায়ুন কবীর: একদিকে সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় বিপুল বরাদ্দ, আধুনিক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে; অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ দুর্বলতা। একাধিক বিদ্যালয় ঘুরে, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে- তদারকির অভাব, শিক্ষকদের পাঠদানে অনাগ্রহ, ক্লাসে মোবাইল ব্যবহার এবং বার্ষিক পরীক্ষার সময় কর্মবিরতির মতো অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে অচল করে দিচ্ছে।
ব্যবস্থাপনার এই চরম সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়ছে অভিভাবকদের সিদ্ধান্তে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়ছেন। ফলে গ্রামের অনেক পরিবার কয়েক মাইল দূরের কিন্ডারগার্টেনে সন্তানদের ভর্তি করছেন- শুধুমাত্র নিয়মিত পাঠদান, উপস্থিতি, তদারকি ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী যোগাযোগের নিশ্চয়তার জন্য।

শিক্ষকদের অনীহা: “ক্লাসে গেলে বসে থাকেন, মোবাইলে স্ক্রল করেন”। বেশ কিছু স্কুলে দেখা গেছে- শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও পাঠদান হয় না নিয়মিতভাবে। ক্লাসে দাঁড়িয়ে পাঠদানের বদলে অনেক শিক্ষক চেয়ারে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
শিশুরা বলে- “স্যার ক্লাসে এসে মোবাইল দেখেন। আমরা চুপচাপ বসে থাকি।”

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন-
“আমরা ভাবি সরকারিভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক আছে কিন্তু বাস্তবে দেখি আগ্রহ নেই, দায়িত্ববোধ নেই। বাচ্চারা ক্লাসে গিয়ে শিখছে না।”

আরেকজন আরো কঠোর ভাষায় বলেন-
“শিক্ষকরা বেতনের সময় সবচেয়ে দ্রুত; কিন্তু ক্লাসরুমে দায়িত্ব পালনে সবচেয়ে ধীর।”

তদারকি নেই-নিয়ম ভাঙলেও জবাবদিহি নেই।বহু বিদ্যালয়েই একাডেমিক সুপারভিশন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। কিছু বিদ্যালয়ে মাসের পর মাস কোনো পরিদর্শক যান না।

অভিভাবকদের অভিযোগ-“তদারকি না থাকলে যে যা খুশি করবে এটাই স্বাভাবিক। এখন স্কুলে কে কী করছে কেউ দেখতেও আসে না।”

পরীক্ষার সময় কর্মবিরতি ‘চরম দায়িত্বহীনতা’ বলছেন অভিভাবকরা। বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বার্ষিক পরীক্ষা। আর ঠিক তখনই শিক্ষকদের আকস্মিক কর্মবিরতি। একে অভিভাবকরা “অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত” হিসেবে দেখছেন।

একজন অভিভাবকের মন্তব্য-“বাচ্চারা সারাবছর পড়লো, আর পরীক্ষার সময় শিক্ষকরা কর্মবিরতি নিলেন! এটা কি কোনো শিক্ষকের কাজ হতে পারে?”

আরেকজন বলেন-“আমরা হতবাক। আজকে শিশুদের স্কুল থেকে বাহির করে দিয়ে তালাবদ্ধ করেছেন শিক্ষকরা। শিশুরা মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। সারাবছরের পড়াশোনাই অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল।”

শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ:
‘এটা কেবল একটি স্কুলের সমস্যা নয়- সিস্টেম ভেঙে পড়ছে’। শিক্ষাবিদদের মতে- ক্লাসরুম পরিচালনায় শৃঙ্খলার অভাব, তদারকি দুর্বলতা, দায়িত্ব পালনে অনীহা, শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা অকার্যকর, প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে মোবাইল অপব্যবহার, এসব মিলেই সংকট তৈরি করেছে।

একজন শিক্ষা বিশ্লেষক বলেন-“সরকার শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে কিন্তু মাঠপর্যায়ে তার প্রভাব নেই। কারণ জবাবদিহি নেই।”

শিক্ষকদের বক্তব্য:
‘চাপ বেশি, সুযোগ-সুবিধা কম। কিছু শিক্ষক যুক্তি দেখিয়েছেন প্রশাসনিক কাজ বেশি অফিসিয়াল অ্যাপস ব্যবহারের কারণে মোবাইল রাখতে হয়, জনবল কম, ক্লাস লোড বেশি।

তবে অভিভাবকরা বলছেন- “মোবাইল প্রয়োজন হলে ঠিক আছে, কিন্তু ক্লাসের সময় ফেসবুক স্ক্রল করা তো দায়িত্ব নয়!”

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার সংকট এতটাই গভীর যে, অভিভাবকেরা সরকারি স্কুল ছেড়ে উল্টো কিন্ডারগার্টেনে ছুটছেন।
অভিভাবকদের ভাষায়- “সরকারি স্কুলে শিক্ষক আছে, বিল্ডিং আছে, সুযোগ-সুবিধা আছে কিন্তু শিক্ষা নেই। তাই অনেক দূরে হলেও আমরা বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেনে দিচ্ছি।”

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com